ওহাবী ফিতনা
ফেতনার জন্ম এবং ফেতনায়ে ওহাবীয়া হাদিসের আলোকেঃ
প্রায় পৌনে চৌদ্দশ’ বছর গত হলো ইসলাম ধর্ম এ পৃথিবীতে এসেছে। এর মধ্যে অনেক বিপদাপদের মুকাবেলা করতে হয়েছে এ পবিত্র ধর্মকে। হুযুর ﷺ এর সুশোভিত এ উদ্যানের উপর দিয়ে অনেক প্রলয়ঙ্করী ঝড়-তুফান বয়ে গেছে। কিন্তু খোদার লাখো শুকরিয়া যে, এ বাগান পূর্ববৎ সজীব ও প্রাণবন্ত রয়েছে। ইসলাম-রবি বার বার কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়েছে, কিন্তু এ সূর্য পূর্ববৎ আলোক উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত রয়ে গেছে। উজ্জ্বল থাকবে না বা কেন? আল্লাহ স্বয়ং এ ধর্মের হিফাজতকারী ও সাহায্যকারী। আলাহ পাক ফরমান ঃ-
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
-‘‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এটির হিফাযতকারী।’’
এ ধর্ম কখনো কুখ্যাত ইয়াযীদের শাসনামলে মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে, কখনও হাজ্জাজের আমলের নির্যাতনে ধূলিধূসরিত হয়েছে, কখনো খলীফা মামুনের আমলে বাতিলপন্থীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে, আবার কখনো তাতারীগণ বীর-বীক্রম এর উপর প্রচন্ডআঘাত হেনেছে, কখনও খারেজীগণ এর মুকাবিলা করেছে, রাফেজীরাও একে সমূলে বিনাশ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু এটি এমনই এক পাহাড়, যার সম্মুখে কোন শক্তিই টিকে থাকতে পারেনি। এটা যেমনি ছিল তেমনি মজবুত রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা একে স্থিরও অটল রাখুন।
এ সমস্ত ফিতনা ও হুকমী সমূহের মধ্যে ওহাবী নজদীদের ফিতনা ছিল সর্বাধিক বিপজ্জনক। এ ব্যাপারে আমাদের নবী করিমﷺ প্রথম থেকেই সতর্ক করে গেছেন, নানাভাবে মুসলমানদেরকে সজাগ করে দিয়েছেন। মিশকাত শরীফের ‘ইয়ামন ও শামের বর্ণনা’ অধ্যায়ে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে হযরত আবদুলল্লাহ ইবন উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত “একদিন দয়ার সাগর হুযুর ﷺ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দু’আ করছিলেনঃ
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا
-‘হে আল্লাহ! আমাদের শাম প্রদেশে বরকত দাও।’
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا
-‘‘হে আল্লাহ! আমাদের ইয়ামন প্রদেশে বরকত দাও। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের নজদের জন্য দু’আ করুন। পুনরায় হুযর ﷺদু’আ করলেন, শাম ও ইয়ামেনের নাম উল্লেখ করলেন কিন্তু নজদের নাম নিলেন না। পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক নজদের জন্য দু’আ করার অনুরোধ করার পরেও হুযুর শাম ও ইয়ামেনের জন্য উপযুর্পরি ৩ বার দু’আ করলেন কিন্তু বারংবার নজদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া সত্তেও নজদের জন্য দু’আ করলেন না। বরং শেষে বললেন,
َاكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ وَبِهَا يَطْلُعُ قرن الشَّيْطَان
-‘‘যে অঞ্চল সৃষ্টির আদিকালেই আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত, সে ভুখন্ডের জন্য দু’আ কিভাবে করি? ওখানেই ইসলামের ভিত্কে নাড়াদানকারী ভূমিকম্প ও ফিত্না আরম্ভ হবে, ওখানেই শয়তানী দলের আবির্ভাব ঘটবে।”
★বোখারীঃ৬/২৫৯৮,হাদিসঃ৬৬৮১
★তিরমিজি :৫/৩৩,হাদিসঃ৩৯৫৩
এ থেকে বোঝা গেল হুযুর ﷺএর পবিত্র দৃষ্টিতে (পথভ্রষ্ট ও ঈমান নষ্ট করার দিক থেকে) দাজ্জালের ফিতনার পরে ছিল নজদের ফিতনার স্থান, যার সম্পর্কে তিনি এভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলেনন।
অনুরুপ, মিশকাত শরীফের কিসাস শীর্ষক আলোচনায় “মুরতাদদের (ধর্মদ্রোহীদের) হত্যা” অধ্যায়ে নাসায়ী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত আবু বরযা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, একবার হুযুর ﷺ কিছু গণীমতের মাল বন্টন করছিলেন, তখন পিছন থেকে একজন লোক বললেন-হে মুহাম্মদ! আপনি ন্যায় সঙ্গতভাবে বণ্টন করেননি। হুযুরﷺ রাগান্বিত হয়ে বললেন, আমার পরে আমার থেকে বেশী কোন ইনসাফকারী ও ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। তারপর বললেন, শেষ যামানায় এর বংশ থেকে একটি গোত্রের উদ্ভব হবে, যারা কুরআন পাঠ করবে বটে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠদেশের নিচে পৌঁছবে না। অধিকন্তু, তারা ইসলাম থেকে এমনিভাবে দূরে সরে যাবে, যেমনি করে তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়। তারপর বললেন ঃ-
سِيمَاهُمُ التَّحْلِيقُ لَا يَزَالُونَ يَخْرُجُونَ حَتَّى يَخْرُجَ آخِرُهُمْ مَعَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ هُمْ شَرُّ الْخَلْقِ والخليقة
-‘‘মাথামুন্ডানো হলো এদের বিশেষ চিহ্ন; এদের একের পর এক বের হতেই থাকবেই। শেষ পর্যন্ত এদের শেষ দলটি দাজ্জালের সংগে মিলিত হবে। যদি তোমরা তাদের সাক্ষাত পাও, জেনে রাখো, তারা হলো সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস)।’’
★নাসায়ীঃ ৭/১১৯ পৃঃ,হাদিস নংঃ৪১০৩
★আহমদঃ৪/৪২১
★মিশকাতঃ৬৪৮ পৃঃ,হাদিস নংঃ৩৫৪৩
এ হাদিসের মধ্যে এদের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। মাথামুন্ডানো ছাড়া এখনও কোন ওহাবীকে পাওয়া মুশকিল। অন্য জায়গায় তিনি আরও বললেন, তারা মুর্তি পুজারীদেরকে ছেড়ে দিবে, কিন্তু মুসলমানদেরকে হত্যা করবে। (বুখারী শরীফ ঃ ১ম খন্ড, কিতাবুল আম্বিয়া, ইয়াজুজ মাজুযের কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত বর্ণনা; মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ ঃ আল-মুজিযাত-অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ দেখুন) উক্ত জায়গায় মিশকাত শরীফে আরও উলেখিত আছে ঃ-
لَئِنْ أَنَا أَدْرَكْتُهُمْ لَأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ.
-“যদি আমি তাদেরকে পেতাম, ‘আদ’ গোত্রের মত হত্যা করতাম।"
★বোখারীঃ৬/২৭০২পৃঃ,হাদিস নংঃ৭৪৩২
★মুসলিমঃ ৪/২৪৩ পৃঃ,১০৬৪
এখনও দেখা যায় যে দেওবন্দীরা সাধারণভাবে হিন্দুদের সাথে বেশী সংশ্রব রাখে, মুসলমানদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। তারা সবসময় মুসলমানদের উপর বিশেষ করে হেরমাইন শরীফাইনের অধিবাসীদের ইযযত, আবরুর উপর প্রচন্ড আঘাত হেনেছেন।
উপরোক্ত মহান ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্বাদশ হিজরীতে নজদে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের জন্ম হয়। তিনি আহলে হেরমাইন ও অন্যান্য মুসলমানদের উপর কি ধরনের অত্যাচার করছে!, তাদের অত্যাচার নিপীড়নের কিঞ্চিত বর্ণনা আল্লামা শামী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব রদ্দুল মুখতার এর ৩য় খন্ড বাবুল বুগাতের শুরুতে লিপিবদ্ধ করেছেন ঃ-
كَمَا وَقَعَ فِي زَمَانِنَا فِي أَتْبَاعِ عَبْدِ الْوَهَّابِ الَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ نَجْدٍ وَتَغَلَّبُوا عَلَى الْحَرَمَيْنِ وَكَانُوا يَنْتَحِلُونَ مَذْهَبَ الْحَنَابِلَةِ، لَكِنَّهُمْ اعْتَقَدُوا أَنَّهُمْ هُمْ الْمُسْلِمُونَ وَأَنَّ مَنْ خَالَفَ اعْتِقَادَهُمْ مُشْرِكُونَ، وَاسْتَبَاحُوا بِذَلِكَ قَتْلَ أَهْلِ السُّنَّةِ وَقَتْلَ عُلَمَائِهِمْ حَتَّى كَسَرَ اللَّهُ تَعَالَى شَوْكَتَهُمْ وَخَرَّبَ بِلَادَهُمْ وَظَفِرَ بِهِمْ عَسَاكِرُ الْمُسْلِمِينَ عَامَ ثَلَاثٍ وَثَلَاثِينَ وَمِائَتَيْنِ وَأَلْفٍ
-‘‘যেমন আমাদের সময়ে সংঘটিত আবুদল ওহাবের অনুসারীদের লোমহর্ষক ঘটনা প্রবাহ প্রণিধানযোগ্য। তারা নজদ থেকে বের হয়ে মক্কা-মদীনার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তারা নিজেদেরকে হাম্বলী মায্হাবের অনুসারী বলে দাবী করতো। আসলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তারাই শুধু মুসলমান আর বাকী সব মুশরিক। এজন্য তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের হত্যা করা জায়েয মনে করেছে এবং এদের অনেক আলেমকে হত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআ’লা তাদের অহংকার চুর্ণ করে তাদের শহরগুলোকে বিরান করে দিয়েছেন। তাদের বিরদ্ধে্ ইসলামী সেনাবাহিনীকে জয়যুক্ত করেছেন। এ লোমহর্ষক ঘটনাটি ১২৩৩ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।’’
★ইননে আবেদীনঃ রুদ্দুল মুখতারঃবাবুল লোগাতঃ৩/৩২৯ পৃঃ
‘সায়ফুল জব্বার’ ও অন্যান্য কিতাবে তাদের অত্যাচারের অগণিত ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে- তারা পবিত্র মক্কা-মদীনার নিরীহ লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে; হেরমাইন শরীফাইনে বসাবাসকারী স্ত্রী-কন্যাদের ধর্ষণ করেছে; পুরুষদেরকে দাস আর নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করেছে। সৈয়দ বংশের অনেককে হত্যা করেছে; এমনকি মসজিদে-নববীর সমস্ত ঝাড়-লণ্ঠন ও গালীচা উঠিয়ে নজদে নিয়ে যায়, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইতের কবরসমূহ ভেঙ্গে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে; এমন কি যে পবিত্র রওযা শরীফকে কেন্দ্র করে প্রতি দিন সকাল-সন্ধ্যায় ফিরিশতাগণ সালাত ও সালাম পাঠ করেন, সেটাও ধরাশায়ী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু যেই লোকটি সেই অসৎ উদ্দ্যেশ্যে রওযা পাকের কাছে গিয়েছিল, আল্লাহর তরফ থেকে নিয়োজিত একটি সাপের কামড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আল্লাহ তা’আলাই তাঁর হাবীবের শেষ বিশ্রামস্থলকে ওদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন।
মোট কথা, ওদের অত্যাচার-নিপীড়ন ছিল সীমাহীন পীড়াদায়ক। যার বর্ণনা করতে গেলে হৃদয় ব্যথিত হয়ে যায়।
কুখ্যাত ইয়াযীদ নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরিবার বর্গের সঙ্গে শত্রুতা করেছে তাঁদের জীবদ্দশায়, কিন্তু তাঁদের ইন্তেকালের ১৩০০ বছর পরেও ওহাবীদের হাতে সাহাবায়ে কেরাম ও মহামান্য আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) লাঞ্চিত হয়েছেন কবরের মধ্যে। ইবনে সাউদ হেরমাইন শরীফাইনে যে ন্যাক্কারজনক বীভৎস কান্ড করেছে, তা এখনও প্রত্যেক হাজীর চোখে ধরা পড়ে। পবিত্র মক্কা নগরীতে আমি নিজেই স্বপক্ষে দেখেছি যে, কোথাও কোন সাহাবীর পবিত্র কবরের চিহ্নও দৃষ্টিগোচর হয় না। উদ্দ্যেশ্য, কেহ যেন ফাতিহা পাঠ করার সুযোগ না পায়। যে স্থানে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, সে পবিত্র জায়গায় একটি তাবু খাটানো দেখেছি, যেখানে কুকুর ও গাধার অবাধ আনাগোনা চলছে। আগে এখানে একটি গুম্বদ বিশিষ্ট ঘর নির্মিত ছিল, যেখানে গিয়ে মানুষ নামায পড়তো, যিয়ারত করতো। এটিই ছিল আমেনা বিবির ঘর। এ ঘরেই ইসলাম রবি আলোক উদ্ভাসিত হয়েছিল। কিন্তু আজ সে পবিত্র জায়গার এহেন বে’ইযযতী ও অবমাননা হচ্ছে। আল্লাহর কাছেই এর অভিযোগ রইল।
এতো গেল আরবের ঘটনাবলী। হিন্দুস্থান সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করা দরকার। দিল্লী শহরে মওলবী ইসমাইল নামে একজন লোক জন্মগ্রহণ করে। তিনি মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহাব নজদী প্রণীত “কিতাবুত তাওহীদ” এর উদ্দুর্ ভাষায় খোলাসা করে অনুবাদ করে ও “তাকবিয়াতুল ঈমান” নামে প্রকাশ করে হিন্দুস্থানে এর ব্যাপক প্রচারের আয়োজন করে। এ তাকবিয়াতুল ঈমান প্রকাশ করার কারণে তিনি সীমান্তে পাঠানদের হাতে নিহত হয়। তাই ওহাবীগণ তাকে শহীদ বলে গণ্য করে শিখদের হাতে নিহত হন বলে প্রচারণা চালায়। (“আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত” গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) আলা হযরত (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ঠিকই বলেছেন--
وه وهابيه نے جسے ديا هے لقب شهيد وذبيح كا
وه شهيد ليلے نجد تها وه ذبيح تيغ خيارهے
-‘‘ওহাবীরা যাকে ‘শহীদ বা জবীহ’ বলে আখ্যায়িত করেছে, আসলে তিনি নজদের ‘লায়লী’র প্রেমে বিভোর হয়ে ধার্মিকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।’’
★ইমাম আহমদ রেযা খানঃ আল কাওকাবুশ শিহাবিয়াঃ ১৪২পৃঃ।
যদি (তাদের কথামতো) শিখেরাই নিহত করতো তাহলে অমৃতসর বা পূর্ব পাঞ্জাবের কোন শহরে তিনি মারা যেত। কেননা, পূর্ব পাঞ্জাবই হলো শিখদের কেন্দ্র। সীমান্ততো পাঠানদের এলাকা, সেখানেই তিনি মারা যায়। অতএব বোঝা গেল, তিনি মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। তার মৃত দেহও উধাও করে ফেলা হয়েছিল। এ জন্য কোথাও তার কোন কবর নেই।
মওলবী ইসমাইলের ভক্ত-অনুসারীবৃন্দ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল মাযহাবী ইমামদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে। এরা লা-মাযহাবী হিসেবে পরিচিত। অপরদল মুসলমানদের ঘৃণা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদেরকে হানাফী বলে দাবী করে, আমাদেরই মত নামায-রোযা পালন করে। তারাই গোলাবী ওহাবী বা দেওবন্দী হিসেবে পরিচিত। আকা মাওলানা হযরত মাহবুবে কিবরিয়া (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এর মুজিযা দেখুন; তিনি বলেছিলেন, “সেখান থেকে শয়তানী দলের আবির্ভাব ঘটবে”। قَرَنُ الشَّيِطَانِ (করনুশ শয়তান) এর উদুর্ অনুবাদ হচ্ছে- ‘দেও বন্দ’ ‘দেও’ অর্থ শয়তান আর ‘বন্দ’ অর্থ দল বা অনুসারী। কিংবা ‘দেওবন্দ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে সম্পর্কে হচ্ছে اضافت مقلوبى (ইযাফতে মকলুবী’র) অর্থাৎ দেওবন্দ শব্দটি ‘বন্দেদেও শব্দ হতে গঠিত, যার অর্থ হচ্ছে- শয়তানের দল বা স্থান। এ উভয় দলের ধমর্ীয় কাজ-কর্ম ও আচার আচরণে বাহ্যিকভাবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও তাদের আকীদার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়েই মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে এবং তার আকীদারই পৃষ্টপোষক। বস্তুতঃ দেওবন্দীদের মুরব্বী মওলবী রশীদ আহমদ সাহেব গাঙ্গুহী তাঁর ‘ফতুয়ায়ে রশীদিয়া’ গ্রন্থের ১ম খন্ডের তাকলীদ শীর্ষক আলোচনার ১১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর অনুসারীদের ওহাবী বলা হয়। তাঁর আকীদা ভাল ছিল। তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিল। অবশ্য তিনি উগ্র মেজাজের লোক ছিলেন। তবে হ্যাঁ , যারা সীমা অতিক্রম করেছে, তারা ফিত্না-ফ্যাসাদের শিকার হয়েছে। তাদের সবার আকীদা ছিল অভিন্ন। শুধু আমলের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কেউ ছিল হানাফী, কেউ শাফিঈ কেউ বা মালেকী আর কেউ হাম্বলী”। (রশীদ আহমদ)
বর্তমান যুগে লা-মাযহাবী ওহাবীফের তুলনায় দেওবন্দীরা অপেক্ষাকৃত বিপজ্জনক। কেননা সাধারণ মুসলমান তাদেরকে সহযে চিনতে পারে না। তাঁরা তাদের রচিত কিতাব সমূহে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শানে যে ধরনের বে-আদবী করেছে তা’ করতে কোন মুশরিকও কখনও সাহস পাবে না। এরপরেও এরা নিজেদেরকে মুসলমানের কন্ডারী ও ইসলামের একমাত্র এজেন্ট বলে দাবী করে থাকে।
মওলবী আশরাফ আলী থানভী তাঁর ‘হিফজুল ঈমান’ নামক কিতাবে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জ্ঞানকে পশুদের জ্ঞানের মত বলেছেন; মওলবী খলিল আহমদ সাহেব আম্বেটবী তাঁর ‘বারাহীনে কাতিয়া’ কিভাবে শয়তান ও হযরত আযরাইল (আলাইহিস্ সালাম) এর জ্ঞান হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জ্ঞানে তুলনায় বেশী বলে মত প্রকাশ করেছে মওলবী ইসমাইল দেহলবী সাহেব তাঁর ‘সিরাতুম-মুস্তাকিম’ কিতাবে নামাযের মধ্যে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খেয়াল আসাটা গাধা-গরুর খেয়াল আসা অপেক্ষা খারাপ বলেছে। মওলবী কাসেম নানুতবী ‘তাহযিরুন নাস’ কিতাবে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে শেষ নবী হিসাবে স্বীকার করেনি। তাঁর কথা হলো হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপরে কোন নবী এসে গেলেও হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শেষ নবী হওয়ার ক্ষে্ত্রে এর কোন প্রভাব পড়বে না। (তাঁর মতে) খাতেম অর্থ আসল নবী এবং অন্যান্য নবীগণ হচ্ছেন আরেযী- (মূখ্য নবীর ভূমিকা অনুসরণকারী নবী)। মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ঠিক একথাই বলেছে- আমি আরেযী নবী। মির্জা গোলাম আহমদকে ক্ষেত্রে মওলভী রশীদ আহমদ সাহেবের (অথবা নানুতবী সাহেবের) সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে গণ্য করা যায়।
এসব মওলভীদের কাছে তাওহীদ হচ্ছে নবীগণকে হেয় প্রতিপন্ন করা, যেমন রাফেজীগণ হযরত আলী (রাদিআল্লহু আনহু) এর প্রতি ভালবাসা বলতে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এর প্রতি শত্র“তা পোষণ মনে করে থাকে। বস্তুতঃ এ তাওহীদ হলো শয়তানী তাওহীদ। শয়তান আদম (আলাইহিস সালাম) কে সম্মান করতে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে মাথা নত করেনি সে। এর পরিণাম কি হয়েছে, সকলেই জানেন। প্রত্যেক لاحول (লা-হাওলা) বলে একে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে থাকে। ইসলামী তাওহীদ হলো আল্লাহকে এক স্বীকার করা এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে ইয্যত ও সম্মান করা। এ তাওহীদের শিক্ষা হচ্ছে-
لَااِلَهَ اِلَهَ اللهُ مُحَمَّدُرَّسُوْلُ اللهِ উক্ত কলেমার প্রথমাংশে আল্লাহর একত্বের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয়াংশে শানে মুস্তাফা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রায় পৌনে চৌদ্দশ’ বছর গত হলো ইসলাম ধর্ম এ পৃথিবীতে এসেছে। এর মধ্যে অনেক বিপদাপদের মুকাবেলা করতে হয়েছে এ পবিত্র ধর্মকে। হুযুর ﷺ এর সুশোভিত এ উদ্যানের উপর দিয়ে অনেক প্রলয়ঙ্করী ঝড়-তুফান বয়ে গেছে। কিন্তু খোদার লাখো শুকরিয়া যে, এ বাগান পূর্ববৎ সজীব ও প্রাণবন্ত রয়েছে। ইসলাম-রবি বার বার কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়েছে, কিন্তু এ সূর্য পূর্ববৎ আলোক উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত রয়ে গেছে। উজ্জ্বল থাকবে না বা কেন? আল্লাহ স্বয়ং এ ধর্মের হিফাজতকারী ও সাহায্যকারী। আলাহ পাক ফরমান ঃ-
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
-‘‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এটির হিফাযতকারী।’’
এ ধর্ম কখনো কুখ্যাত ইয়াযীদের শাসনামলে মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে, কখনও হাজ্জাজের আমলের নির্যাতনে ধূলিধূসরিত হয়েছে, কখনো খলীফা মামুনের আমলে বাতিলপন্থীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে, আবার কখনো তাতারীগণ বীর-বীক্রম এর উপর প্রচন্ডআঘাত হেনেছে, কখনও খারেজীগণ এর মুকাবিলা করেছে, রাফেজীরাও একে সমূলে বিনাশ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু এটি এমনই এক পাহাড়, যার সম্মুখে কোন শক্তিই টিকে থাকতে পারেনি। এটা যেমনি ছিল তেমনি মজবুত রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা একে স্থিরও অটল রাখুন।
এ সমস্ত ফিতনা ও হুকমী সমূহের মধ্যে ওহাবী নজদীদের ফিতনা ছিল সর্বাধিক বিপজ্জনক। এ ব্যাপারে আমাদের নবী করিমﷺ প্রথম থেকেই সতর্ক করে গেছেন, নানাভাবে মুসলমানদেরকে সজাগ করে দিয়েছেন। মিশকাত শরীফের ‘ইয়ামন ও শামের বর্ণনা’ অধ্যায়ে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে হযরত আবদুলল্লাহ ইবন উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত “একদিন দয়ার সাগর হুযুর ﷺ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দু’আ করছিলেনঃ
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا
-‘হে আল্লাহ! আমাদের শাম প্রদেশে বরকত দাও।’
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا
-‘‘হে আল্লাহ! আমাদের ইয়ামন প্রদেশে বরকত দাও। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের নজদের জন্য দু’আ করুন। পুনরায় হুযর ﷺদু’আ করলেন, শাম ও ইয়ামেনের নাম উল্লেখ করলেন কিন্তু নজদের নাম নিলেন না। পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক নজদের জন্য দু’আ করার অনুরোধ করার পরেও হুযুর শাম ও ইয়ামেনের জন্য উপযুর্পরি ৩ বার দু’আ করলেন কিন্তু বারংবার নজদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া সত্তেও নজদের জন্য দু’আ করলেন না। বরং শেষে বললেন,
َاكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ وَبِهَا يَطْلُعُ قرن الشَّيْطَان
-‘‘যে অঞ্চল সৃষ্টির আদিকালেই আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত, সে ভুখন্ডের জন্য দু’আ কিভাবে করি? ওখানেই ইসলামের ভিত্কে নাড়াদানকারী ভূমিকম্প ও ফিত্না আরম্ভ হবে, ওখানেই শয়তানী দলের আবির্ভাব ঘটবে।”
★বোখারীঃ৬/২৫৯৮,হাদিসঃ৬৬৮১
★তিরমিজি :৫/৩৩,হাদিসঃ৩৯৫৩
এ থেকে বোঝা গেল হুযুর ﷺএর পবিত্র দৃষ্টিতে (পথভ্রষ্ট ও ঈমান নষ্ট করার দিক থেকে) দাজ্জালের ফিতনার পরে ছিল নজদের ফিতনার স্থান, যার সম্পর্কে তিনি এভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলেনন।
অনুরুপ, মিশকাত শরীফের কিসাস শীর্ষক আলোচনায় “মুরতাদদের (ধর্মদ্রোহীদের) হত্যা” অধ্যায়ে নাসায়ী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত আবু বরযা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, একবার হুযুর ﷺ কিছু গণীমতের মাল বন্টন করছিলেন, তখন পিছন থেকে একজন লোক বললেন-হে মুহাম্মদ! আপনি ন্যায় সঙ্গতভাবে বণ্টন করেননি। হুযুরﷺ রাগান্বিত হয়ে বললেন, আমার পরে আমার থেকে বেশী কোন ইনসাফকারী ও ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। তারপর বললেন, শেষ যামানায় এর বংশ থেকে একটি গোত্রের উদ্ভব হবে, যারা কুরআন পাঠ করবে বটে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠদেশের নিচে পৌঁছবে না। অধিকন্তু, তারা ইসলাম থেকে এমনিভাবে দূরে সরে যাবে, যেমনি করে তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়। তারপর বললেন ঃ-
سِيمَاهُمُ التَّحْلِيقُ لَا يَزَالُونَ يَخْرُجُونَ حَتَّى يَخْرُجَ آخِرُهُمْ مَعَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ هُمْ شَرُّ الْخَلْقِ والخليقة
-‘‘মাথামুন্ডানো হলো এদের বিশেষ চিহ্ন; এদের একের পর এক বের হতেই থাকবেই। শেষ পর্যন্ত এদের শেষ দলটি দাজ্জালের সংগে মিলিত হবে। যদি তোমরা তাদের সাক্ষাত পাও, জেনে রাখো, তারা হলো সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস)।’’
★নাসায়ীঃ ৭/১১৯ পৃঃ,হাদিস নংঃ৪১০৩
★আহমদঃ৪/৪২১
★মিশকাতঃ৬৪৮ পৃঃ,হাদিস নংঃ৩৫৪৩
এ হাদিসের মধ্যে এদের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। মাথামুন্ডানো ছাড়া এখনও কোন ওহাবীকে পাওয়া মুশকিল। অন্য জায়গায় তিনি আরও বললেন, তারা মুর্তি পুজারীদেরকে ছেড়ে দিবে, কিন্তু মুসলমানদেরকে হত্যা করবে। (বুখারী শরীফ ঃ ১ম খন্ড, কিতাবুল আম্বিয়া, ইয়াজুজ মাজুযের কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত বর্ণনা; মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ ঃ আল-মুজিযাত-অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ দেখুন) উক্ত জায়গায় মিশকাত শরীফে আরও উলেখিত আছে ঃ-
لَئِنْ أَنَا أَدْرَكْتُهُمْ لَأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ.
-“যদি আমি তাদেরকে পেতাম, ‘আদ’ গোত্রের মত হত্যা করতাম।"
★বোখারীঃ৬/২৭০২পৃঃ,হাদিস নংঃ৭৪৩২
★মুসলিমঃ ৪/২৪৩ পৃঃ,১০৬৪
এখনও দেখা যায় যে দেওবন্দীরা সাধারণভাবে হিন্দুদের সাথে বেশী সংশ্রব রাখে, মুসলমানদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। তারা সবসময় মুসলমানদের উপর বিশেষ করে হেরমাইন শরীফাইনের অধিবাসীদের ইযযত, আবরুর উপর প্রচন্ড আঘাত হেনেছেন।
উপরোক্ত মহান ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্বাদশ হিজরীতে নজদে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের জন্ম হয়। তিনি আহলে হেরমাইন ও অন্যান্য মুসলমানদের উপর কি ধরনের অত্যাচার করছে!, তাদের অত্যাচার নিপীড়নের কিঞ্চিত বর্ণনা আল্লামা শামী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব রদ্দুল মুখতার এর ৩য় খন্ড বাবুল বুগাতের শুরুতে লিপিবদ্ধ করেছেন ঃ-
كَمَا وَقَعَ فِي زَمَانِنَا فِي أَتْبَاعِ عَبْدِ الْوَهَّابِ الَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ نَجْدٍ وَتَغَلَّبُوا عَلَى الْحَرَمَيْنِ وَكَانُوا يَنْتَحِلُونَ مَذْهَبَ الْحَنَابِلَةِ، لَكِنَّهُمْ اعْتَقَدُوا أَنَّهُمْ هُمْ الْمُسْلِمُونَ وَأَنَّ مَنْ خَالَفَ اعْتِقَادَهُمْ مُشْرِكُونَ، وَاسْتَبَاحُوا بِذَلِكَ قَتْلَ أَهْلِ السُّنَّةِ وَقَتْلَ عُلَمَائِهِمْ حَتَّى كَسَرَ اللَّهُ تَعَالَى شَوْكَتَهُمْ وَخَرَّبَ بِلَادَهُمْ وَظَفِرَ بِهِمْ عَسَاكِرُ الْمُسْلِمِينَ عَامَ ثَلَاثٍ وَثَلَاثِينَ وَمِائَتَيْنِ وَأَلْفٍ
-‘‘যেমন আমাদের সময়ে সংঘটিত আবুদল ওহাবের অনুসারীদের লোমহর্ষক ঘটনা প্রবাহ প্রণিধানযোগ্য। তারা নজদ থেকে বের হয়ে মক্কা-মদীনার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তারা নিজেদেরকে হাম্বলী মায্হাবের অনুসারী বলে দাবী করতো। আসলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তারাই শুধু মুসলমান আর বাকী সব মুশরিক। এজন্য তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের হত্যা করা জায়েয মনে করেছে এবং এদের অনেক আলেমকে হত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআ’লা তাদের অহংকার চুর্ণ করে তাদের শহরগুলোকে বিরান করে দিয়েছেন। তাদের বিরদ্ধে্ ইসলামী সেনাবাহিনীকে জয়যুক্ত করেছেন। এ লোমহর্ষক ঘটনাটি ১২৩৩ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।’’
★ইননে আবেদীনঃ রুদ্দুল মুখতারঃবাবুল লোগাতঃ৩/৩২৯ পৃঃ
‘সায়ফুল জব্বার’ ও অন্যান্য কিতাবে তাদের অত্যাচারের অগণিত ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে- তারা পবিত্র মক্কা-মদীনার নিরীহ লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে; হেরমাইন শরীফাইনে বসাবাসকারী স্ত্রী-কন্যাদের ধর্ষণ করেছে; পুরুষদেরকে দাস আর নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করেছে। সৈয়দ বংশের অনেককে হত্যা করেছে; এমনকি মসজিদে-নববীর সমস্ত ঝাড়-লণ্ঠন ও গালীচা উঠিয়ে নজদে নিয়ে যায়, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইতের কবরসমূহ ভেঙ্গে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে; এমন কি যে পবিত্র রওযা শরীফকে কেন্দ্র করে প্রতি দিন সকাল-সন্ধ্যায় ফিরিশতাগণ সালাত ও সালাম পাঠ করেন, সেটাও ধরাশায়ী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু যেই লোকটি সেই অসৎ উদ্দ্যেশ্যে রওযা পাকের কাছে গিয়েছিল, আল্লাহর তরফ থেকে নিয়োজিত একটি সাপের কামড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আল্লাহ তা’আলাই তাঁর হাবীবের শেষ বিশ্রামস্থলকে ওদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন।
মোট কথা, ওদের অত্যাচার-নিপীড়ন ছিল সীমাহীন পীড়াদায়ক। যার বর্ণনা করতে গেলে হৃদয় ব্যথিত হয়ে যায়।
কুখ্যাত ইয়াযীদ নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরিবার বর্গের সঙ্গে শত্রুতা করেছে তাঁদের জীবদ্দশায়, কিন্তু তাঁদের ইন্তেকালের ১৩০০ বছর পরেও ওহাবীদের হাতে সাহাবায়ে কেরাম ও মহামান্য আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) লাঞ্চিত হয়েছেন কবরের মধ্যে। ইবনে সাউদ হেরমাইন শরীফাইনে যে ন্যাক্কারজনক বীভৎস কান্ড করেছে, তা এখনও প্রত্যেক হাজীর চোখে ধরা পড়ে। পবিত্র মক্কা নগরীতে আমি নিজেই স্বপক্ষে দেখেছি যে, কোথাও কোন সাহাবীর পবিত্র কবরের চিহ্নও দৃষ্টিগোচর হয় না। উদ্দ্যেশ্য, কেহ যেন ফাতিহা পাঠ করার সুযোগ না পায়। যে স্থানে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, সে পবিত্র জায়গায় একটি তাবু খাটানো দেখেছি, যেখানে কুকুর ও গাধার অবাধ আনাগোনা চলছে। আগে এখানে একটি গুম্বদ বিশিষ্ট ঘর নির্মিত ছিল, যেখানে গিয়ে মানুষ নামায পড়তো, যিয়ারত করতো। এটিই ছিল আমেনা বিবির ঘর। এ ঘরেই ইসলাম রবি আলোক উদ্ভাসিত হয়েছিল। কিন্তু আজ সে পবিত্র জায়গার এহেন বে’ইযযতী ও অবমাননা হচ্ছে। আল্লাহর কাছেই এর অভিযোগ রইল।
এতো গেল আরবের ঘটনাবলী। হিন্দুস্থান সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করা দরকার। দিল্লী শহরে মওলবী ইসমাইল নামে একজন লোক জন্মগ্রহণ করে। তিনি মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহাব নজদী প্রণীত “কিতাবুত তাওহীদ” এর উদ্দুর্ ভাষায় খোলাসা করে অনুবাদ করে ও “তাকবিয়াতুল ঈমান” নামে প্রকাশ করে হিন্দুস্থানে এর ব্যাপক প্রচারের আয়োজন করে। এ তাকবিয়াতুল ঈমান প্রকাশ করার কারণে তিনি সীমান্তে পাঠানদের হাতে নিহত হয়। তাই ওহাবীগণ তাকে শহীদ বলে গণ্য করে শিখদের হাতে নিহত হন বলে প্রচারণা চালায়। (“আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত” গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) আলা হযরত (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ঠিকই বলেছেন--
وه وهابيه نے جسے ديا هے لقب شهيد وذبيح كا
وه شهيد ليلے نجد تها وه ذبيح تيغ خيارهے
-‘‘ওহাবীরা যাকে ‘শহীদ বা জবীহ’ বলে আখ্যায়িত করেছে, আসলে তিনি নজদের ‘লায়লী’র প্রেমে বিভোর হয়ে ধার্মিকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।’’
★ইমাম আহমদ রেযা খানঃ আল কাওকাবুশ শিহাবিয়াঃ ১৪২পৃঃ।
যদি (তাদের কথামতো) শিখেরাই নিহত করতো তাহলে অমৃতসর বা পূর্ব পাঞ্জাবের কোন শহরে তিনি মারা যেত। কেননা, পূর্ব পাঞ্জাবই হলো শিখদের কেন্দ্র। সীমান্ততো পাঠানদের এলাকা, সেখানেই তিনি মারা যায়। অতএব বোঝা গেল, তিনি মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। তার মৃত দেহও উধাও করে ফেলা হয়েছিল। এ জন্য কোথাও তার কোন কবর নেই।
মওলবী ইসমাইলের ভক্ত-অনুসারীবৃন্দ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল মাযহাবী ইমামদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে। এরা লা-মাযহাবী হিসেবে পরিচিত। অপরদল মুসলমানদের ঘৃণা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদেরকে হানাফী বলে দাবী করে, আমাদেরই মত নামায-রোযা পালন করে। তারাই গোলাবী ওহাবী বা দেওবন্দী হিসেবে পরিচিত। আকা মাওলানা হযরত মাহবুবে কিবরিয়া (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এর মুজিযা দেখুন; তিনি বলেছিলেন, “সেখান থেকে শয়তানী দলের আবির্ভাব ঘটবে”। قَرَنُ الشَّيِطَانِ (করনুশ শয়তান) এর উদুর্ অনুবাদ হচ্ছে- ‘দেও বন্দ’ ‘দেও’ অর্থ শয়তান আর ‘বন্দ’ অর্থ দল বা অনুসারী। কিংবা ‘দেওবন্দ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে সম্পর্কে হচ্ছে اضافت مقلوبى (ইযাফতে মকলুবী’র) অর্থাৎ দেওবন্দ শব্দটি ‘বন্দেদেও শব্দ হতে গঠিত, যার অর্থ হচ্ছে- শয়তানের দল বা স্থান। এ উভয় দলের ধমর্ীয় কাজ-কর্ম ও আচার আচরণে বাহ্যিকভাবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও তাদের আকীদার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়েই মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে এবং তার আকীদারই পৃষ্টপোষক। বস্তুতঃ দেওবন্দীদের মুরব্বী মওলবী রশীদ আহমদ সাহেব গাঙ্গুহী তাঁর ‘ফতুয়ায়ে রশীদিয়া’ গ্রন্থের ১ম খন্ডের তাকলীদ শীর্ষক আলোচনার ১১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর অনুসারীদের ওহাবী বলা হয়। তাঁর আকীদা ভাল ছিল। তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিল। অবশ্য তিনি উগ্র মেজাজের লোক ছিলেন। তবে হ্যাঁ , যারা সীমা অতিক্রম করেছে, তারা ফিত্না-ফ্যাসাদের শিকার হয়েছে। তাদের সবার আকীদা ছিল অভিন্ন। শুধু আমলের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কেউ ছিল হানাফী, কেউ শাফিঈ কেউ বা মালেকী আর কেউ হাম্বলী”। (রশীদ আহমদ)
বর্তমান যুগে লা-মাযহাবী ওহাবীফের তুলনায় দেওবন্দীরা অপেক্ষাকৃত বিপজ্জনক। কেননা সাধারণ মুসলমান তাদেরকে সহযে চিনতে পারে না। তাঁরা তাদের রচিত কিতাব সমূহে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শানে যে ধরনের বে-আদবী করেছে তা’ করতে কোন মুশরিকও কখনও সাহস পাবে না। এরপরেও এরা নিজেদেরকে মুসলমানের কন্ডারী ও ইসলামের একমাত্র এজেন্ট বলে দাবী করে থাকে।
মওলবী আশরাফ আলী থানভী তাঁর ‘হিফজুল ঈমান’ নামক কিতাবে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জ্ঞানকে পশুদের জ্ঞানের মত বলেছেন; মওলবী খলিল আহমদ সাহেব আম্বেটবী তাঁর ‘বারাহীনে কাতিয়া’ কিভাবে শয়তান ও হযরত আযরাইল (আলাইহিস্ সালাম) এর জ্ঞান হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জ্ঞানে তুলনায় বেশী বলে মত প্রকাশ করেছে মওলবী ইসমাইল দেহলবী সাহেব তাঁর ‘সিরাতুম-মুস্তাকিম’ কিতাবে নামাযের মধ্যে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খেয়াল আসাটা গাধা-গরুর খেয়াল আসা অপেক্ষা খারাপ বলেছে। মওলবী কাসেম নানুতবী ‘তাহযিরুন নাস’ কিতাবে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে শেষ নবী হিসাবে স্বীকার করেনি। তাঁর কথা হলো হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপরে কোন নবী এসে গেলেও হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শেষ নবী হওয়ার ক্ষে্ত্রে এর কোন প্রভাব পড়বে না। (তাঁর মতে) খাতেম অর্থ আসল নবী এবং অন্যান্য নবীগণ হচ্ছেন আরেযী- (মূখ্য নবীর ভূমিকা অনুসরণকারী নবী)। মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ঠিক একথাই বলেছে- আমি আরেযী নবী। মির্জা গোলাম আহমদকে ক্ষেত্রে মওলভী রশীদ আহমদ সাহেবের (অথবা নানুতবী সাহেবের) সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে গণ্য করা যায়।
এসব মওলভীদের কাছে তাওহীদ হচ্ছে নবীগণকে হেয় প্রতিপন্ন করা, যেমন রাফেজীগণ হযরত আলী (রাদিআল্লহু আনহু) এর প্রতি ভালবাসা বলতে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এর প্রতি শত্র“তা পোষণ মনে করে থাকে। বস্তুতঃ এ তাওহীদ হলো শয়তানী তাওহীদ। শয়তান আদম (আলাইহিস সালাম) কে সম্মান করতে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে মাথা নত করেনি সে। এর পরিণাম কি হয়েছে, সকলেই জানেন। প্রত্যেক لاحول (লা-হাওলা) বলে একে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে থাকে। ইসলামী তাওহীদ হলো আল্লাহকে এক স্বীকার করা এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে ইয্যত ও সম্মান করা। এ তাওহীদের শিক্ষা হচ্ছে-
لَااِلَهَ اِلَهَ اللهُ مُحَمَّدُرَّسُوْلُ اللهِ উক্ত কলেমার প্রথমাংশে আল্লাহর একত্বের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয়াংশে শানে মুস্তাফা প্রকাশ করা হয়েছে।
Comments
Post a Comment